• হোম
  • স্কুল ১-১২
  • সাধারণ
  • অষ্টম শ্রেণি

প্রবন্ধ রচনা

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

প্রবন্ধ রচনা

বাংলাদেশের বন্যা

ভূমিকা: প্রকৃতির রূপসী কন্যা আমাদের এই দেশ। এই প্রকৃতিই আবার কখনো কখনো হাজির হয় তার রণচণ্ডী রূপ নিয়ে। প্রকৃতির রুদ্র মূর্তিকেই আমরা বলি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতি বছরই বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের প্রকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। ক্ষুধা, দারিদ্রদ্র্য, বেকারত্ব, জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মতো সমস্যার দেশে একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো বন্যা। ভৌগোলিক এবং ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণেই বন্যা এদেশের নিত্যসঙ্গী।

বাংলাদেশে বন্যার প্রকৃতি: বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয়। বন্যার রূপও বড় ভয়ংকর। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। গাছপালা ঘরবাড়ির চিহ্ন দেখা যায় না। অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে জলস্ফীতি দেখা দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে নদ-নদীতেও প্লাবন আসে। বর্ষা আর প্লাবনের এই অস্বাভাবিক অবস্থাই হলো বন্যা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বন্যা দেখা দেয় যা ভয়াবহ পরিণতি ঘটিয়ে মানুষের জীবনে ডেকে আনে দুর্ভোগ। বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যার ফলে কোনো না কোনো অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে দেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। দুঃখ-দুর্গতিতে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

বন্যার কারণ: বাংলাদেশে বন্যার কারণকে মূলত দুটি উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায়। যথা:

ক. প্রাকৃতিক কারণ ও

খ. কৃত্রিম কারণ

নিম্নে এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

ক. প্রাকৃতিক কারণ:

১. ভৌগোলিক অবস্থান: ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশে বন্যার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশ গঙ্গা,. যমুনা ও মেঘনার মিলনস্থলে অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৬-৭ মিটার উঁচু। বর্ষাকালে উল্লিখিত তিন নদীর অববাহিকায় পানি একসঙ্গে এসে পড়ে। এর ফলে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং বন্যা হয়।

২. পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধি ও বনাঞ্চল ধ্বংস: একদিকে পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্যদিকে বনাঞ্চলসমূহ দ্রুত ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। এর ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে হিমালয়ের বরফ গলে তা নিচে নেমে আসছে। এ পানি গঙ্গা, যমুনা, মেঘনা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আমাদের দেশে আসে এবং বন্যার সৃষ্টি হয়।

৩.. নিম্নাঞ্চল ভরাট হওয়া আমাদের দেশের প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলেই রয়েছে বড় বড় নিম্নাঞ্চল এবং ছোট জলাভূমি। এই জলাভূমিগুলো প্রধান তিনটি নদীর পানি সংরক্ষণ করে। কিন্তু এগুলো ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি'প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে বন্যার সৃষ্টি হয়।

৪. মৌসুমি বায়ুর প্রভাব: বর্ষাকালে আমাদের দেশে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বাতাস দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। এতে জলস্রোতের দক্ষিণমুখী নিঃসরণ বাধা পায়। তখন প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে বঙ্গোপসাগরের পানি সমতল থেকে ৩-৪ ফুট বেড়ে যায় এবং এই পানি নদীপথে দেশের অভ্যন্তরে চলে আসে।

৫. সামুদ্রিক জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনা এই তিনটি প্রধান নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট জোয়ারের পানির চাপ নদীর পানির চাপের চেয়ে ৫ গুণ বেশি। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে নদীর পানি প্রবাহ বাধা পায় এবং তা সাগরে পতিত না হয়ে ওভার ফ্লো হয়ে বন্যার সৃষ্টি করে।

৬. ভূ-গর্ভের অগভীর স্তরে পানি প্রবাহ: ভূ-গর্ভের অগভীর স্তরে পানি প্রবাহের ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়।

৭. নিম্নচাপ: বর্ষকালে বাংলাদেশে সমুদ্রে নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। এ নিম্নচাপ বন্যা পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তোলে।

খ. মানবসৃষ্ট কারণ বা কৃত্রিম কারণ

১. অবকাঠামো নির্মাণ: মানুষ তার জীবনযাত্রার সুবিধার জন্য নদী অববাহিকায় ব্রিজ নির্মাণ করেছে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। নদীর তীর বরাবর বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর পানি অববাহিকায় প্লাবিত হতে পারে না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে নদীর তলদেশে পলি-বালি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হলে বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়।

২. বৃক্ষ নিধন: গঙ্গা, যমুনা নদীর উৎসস্থলে ব্যাপকভাবে বন ধ্বংসের ফলে বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় বৃষ্টির পানি নদীর-নালায় আসার আগে বনাঞ্চলের গাছপালা, ঝোপ-ঝাড়, ঝরা পাতা ও শিকড়ে বাধা পেয়ে ভূগর্ভে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যাপক হারে বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ায় বৃষ্টিপাতের বেশিরভাগ পানি বাধা না পেয়ে নদীতে চলে আসায় নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়া নদীর উৎসে বনাঞ্চল কেটে ফেলায় বিরাণ এলাকায় প্রভূত পলিমাটি জমা হয়ে প্রবাহ পথ বন্ধ হয়ে যায়।

৩. গঙ্গা নদীর ফারাক্কা বাঁধ: বাংলাদেশের বন্যার একটি প্রধান কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা বাঁধ। ভারত প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে ফারাক্কায় পানি আটকে রাখে এবং বর্ষা মৌসুমে সবগুলো গেট একসঙ্গে খুলে দেয়। এর ফলে বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পায়।

৪. ভূমিক্ষয়: অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, দালানকোঠা প্রভৃতি নির্মাণে নিম্নভূমির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ভূমি ক্ষয় হয়ে যায়। তাছাড়া ভূমিকম্পের ফলে অতিরিক্ত মাটি ক্ষয় হয়ে নদীমুখ বন্ধ ও নদীর দিক পরিবর্তন করে ফেলছে। এর ফলে নদীর পানির ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বন্যা সমস্যার প্রতিকার: ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে স্থায়িভাবে বন্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বন্যার ভয়াবহতা ও ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমানো যেতে পারে। বন্যা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তিন ধরনের পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। যথা-

  • তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা;
  • দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা;
  • সমন্বিত ব্যবস্থা।

তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাসমূহ:

১. প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা: বন্যা প্রতিরোধে এ সম্পর্কে প্রাক্-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রযুক্তিগতভাবে এই ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। ভূতাত্ত্বিক ও আঞ্চলিক পরিবাহ-এর মাধ্যমে সতর্কীকরণ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো যায়।

২. ত্রাণব্যবস্থা সক্রিয়করণ বন্যা পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ত্রাণসামগ্রীর। তাই বন্যা-পরবর্তী ত্রাণব্যবস্থা সক্রিয় রাখতে হবে। ত্রাণব্যবস্থা সক্রিয় রাখার উদ্দেশ্যে ও ত্বরিত সাহায্য সরবরাহের জন্য আঞ্চলিক পর্যায়ে যথেষ্ট ত্রাণসামগ্রী মজুদ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ বন্যাদুর্গত এলাকায় দুর্দশা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হলে পানিবন্দী এলাকায় প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি করে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে একটি বিদ্যালয়গৃহকে বহুতল ভবনে রূপান্তরিত করা যেতে পারে এবং তাতে অন্তত ৩,০০০ লোক ধারণ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৪. স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান স্থাপন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে বন্যা প্রতিরোধের জন্য আরও কার্যকর ও সক্রিয় হতে হবে। এক্ষেত্রে একটি দুর্যোগসংক্রান্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি বন্যাসহ সকল দুর্যোগ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা ও পরিচালনা করবে।

৫. অন্যান্য ব্যবস্থা: সরকার ও জনগণের বন্যার আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করা, ঘরবাড়ির ভিটে উঁচু করা, গুচ্ছগ্রাম গড়ে তোলা, বন্যার প্রকোপে বেঁচে থাকার উপযোগী ধান উদ্ভাবন ও চাষ করা ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

সমন্বিত ব্যবস্থা: ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীনকে নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে-

  • বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য প্রধান নদী ও শাখা নদীগুলোর মুখ খনন করতে হবে।
  • নদীর তীর বরাবর উঁচু করে বাঁধ নির্মাণ করা।
  • পানি যেন বেশি পরিমাণে সাগরে চলে যেতে না পারে এ উদ্দেশ্যে নদীর তলদেশ খনন করতে হবে।
  • নদীর মুখ বন্ধ করে রাস্তাঘাট সেতু নির্মাণ করা যাবে না।
  • ব্যাপকভাবে বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা।
  • নদী খনন অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তিনটি প্রধান নদীকে নিয়মিত ড্রেজিং করে পানি সংরক্ষণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। খননকৃত মাটি দ্বারা উঁচু আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করতে হবে।
  • কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে বন্যা উপযোগী করতে হবে।

বন্যায় সৃষ্ট অসুবিধাসমূহ: বন্যা যে বাংলাদেশের মানুষের কত ভয়াবহ অসুবিধা সৃষ্টি করে তা কেবল ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। মানুষের জমির ফসল, ঘরবাড়ি সব পানির নিচে তলিয়ে যায়। পশু-পাখি, গাছপালা পানিতে ভেসে যায়। অনাহারে মানুষ, গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে। বন্যা পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ে মহামারী, রোগব্যাধি।

উপসংহার: বন্যা বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক সর্বনাশা দৈত্য যে তাদের জীবনকে তছনছ করে দেয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বন্যার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা কোনো দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। বন্যার প্রধান কারণ হলো পানি বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাব। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে এখন আর বসে থাকা চলে না। সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বন্যা প্রতিরোধ করা যায় এবং বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।