• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
সরকার কাঠামো ও সরকারের অঙ্গসমূহ

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

সরকার কাঠামো ও সরকারের অঙ্গসমূহ

আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি Power and Functions of the Legislature

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভার কার্যাবলি ব্যাপক ও বিস্তৃত। এ প্রসঙ্গে Alan R. Ball-এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, "সাংবিধানিক কাঠামো, কার্য ব্যবস্থার প্রকৃতি, নির্বাচন ব্যবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পার্থক্য, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের স্তরভেদ অনুসারে আইনসভার প্রকৃতি ও ভূমিকা স্থিরীকৃত হয়।"

এই দৃষ্টিকোণে অ্যালান আর, বল (Alan R. Ball) আইনসভার কার্যাবলিকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন-

১. আইন প্রণয়নসংক্রান্ত
২. শাসন বিভাগ নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত এবং
৩. প্রতিনিধিত্বমূলক কাজ।

নিচে আইন বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি সবিস্তারে আলোচিত হলো:

১. আইন প্রণয়নসংক্রান্ত কাজ (Law making): আইনসভার প্রধান এবং মুখ্য কাজ হলো আইন প্রণয়ন করা। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের ভিত্তিতে দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয় এবং বিচারকার্য সম্পাদিত হয়। দেশের সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে এবং জনমতের গতি-প্রকৃতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আইনসভা নতুন আইন প্রণয়ন করে। আইনসভা কেবল আইন প্রণয়নই করে না বরং প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন আইনের সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে থাকে।

২. শাসন সংক্রান্ত (Executive and control over executive): আইনসভাকে শাসনসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজও সম্পাদন করতে হয়। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় এমনকি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায়ও আইনসভাকে শাসনসংক্রান্ত কার্য সম্পাদন করতে হয়। আইনসভা অনেক সময় উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী নিয়োগ করে। সন্ধি বা চুক্তি অনুমোদন করা, যুদ্ধ ঘোষণা করা প্রভৃতি আইনসভার শাসনসংক্রান্ত কার্য। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের সাথে পরামর্শসাপেক্ষে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগদান করেন। আবার যুদ্ধ ঘোষণা করতে হলে কংগ্রেসের (Congress) অনুমোদন প্রয়োজন হয়। । নিয়োগদান য

৩. অর্থ সংক্রান্ত (Financial): আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আইনসভা জাতীয় অর্থ তহবিলের নিয়ন্ত্রক ও তদারকির ভূমিকা পালন করে। কর ধার্য, কর আদায় এবং অর্থ ব্যয়ের জন্য আইনসভার অনুমোদন প্রয়োজন। আইনসভার অনুমোদন ব্যতীত সরকারি অর্থ আয় ও ব্যয় করা সম্ভব নয়। প্রত্যেক অর্থ-বছরের শুরুতে আইনসভার সদস্যগণ খাতওয়ারী অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি বা কমানোর সুপারিশ করতে পারে। সরকারি হিসাব সংক্রান্ত কমিটি, মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক-এর মাধ্যমে আইনসভা সরকারি আয়-ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করে।

৪. বিচারসংক্রান্ত কাজ (Judicial): আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইনসভা বিচারসংক্রান্ত কাজও করে থাকে। আইনসভার সদস্যদের আচরণের বিচার, অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম সংক্রান্ত সমস্যাবলির বিচার, নির্বাচন সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসা, রাষ্ট্রপতিসহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অপরাধের কারণে অপসারণ প্রস্তাব আনীত হয় আইনসভায় এবং তার সমাধানও আইনসভায় হয়। আবার কোনো কোনো দেশে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনীত হলে আইনসভায় তার বিচার করা হয়। ইংল্যান্ডের লর্ড সভা (House of Lords) আপিল সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ আদালত। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Senate প্রেসিডেন্টসহ উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের গুরুতর অভিযোগের বিচার করে।

৫. আলোচনা সংক্রান্ত (Deliberative): আইনসভায় উত্থাপিত কোনো বিলেই আলোচনা ব্যতীত আইনে পরিণত হয় না। আইন প্রণয়ন, নীতি নির্ধারণ সরকারি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আইনসভায় ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এর ফলে সুষ্ঠু ও উন্নত ধরনের নীতি ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কারণ আইন পরিষদকে জাতির মুখপাত্র ও ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্র বলা হয়। উক্ত আলোচনা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়ে রাষ্ট্রের সর্বত্র রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করে।

৬. সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধন সংক্রান্ত কাজ (Making and Amending of the Constitution) কোনো কোনো দেশের আইন পরিষদ সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গণপরিষদের (Constitutent Assembly) দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল তা গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত হয়। পাশাপাশি আইনসভা সংবিধানের কোনো ধারা-উপধারা পরিবর্তন কিংবা সংশোধন করে থাকে। যেমন- আমাদের দেশের আইনসভায় সংবিধানের ১৬টি সংশোধনী গৃহীত হয়েছে।

৭. নির্বাচন সংক্রান্ত (Electoral): আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন পরিষদ নির্বাচনি সংস্থা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। ভারতের আইনসভার নির্বাচিত সদস্যগণ রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি যদিও নির্বাচনি সংস্থার (Electoral College) মাধ্যমে নির্বাচিত হন তথাপি কোনো প্রার্থী নির্বাচনি সংস্থার সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে ব্যর্থ হলে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে প্রথম তিনজন প্রার্থীর মধ্যে যেকোনো একজনকে প্রতিনিধি পরিষদ (House of Representatives) রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে পারে।

৮. অনুসন্ধান সংক্রান্ত (Enquiary): গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনুসন্ধান কার্য পরিচালনার জন্য কমিশন নিয়োগ করে থাকে। কখনো কখনো দুর্নীতি তদন্তের জন্য কমিটি বা কমিশন নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষা, প্রশাসন, কৃষি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে শাসন বিভাগকে কার্যকরী নীতি নির্ধারণের নির্দেশ দেয়।

৯. তথ্যাদি সরবরাহ সংক্রান্ত (Supplying information): আইনসভা সরকারের কার্যের গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে তথ্যাদি সরবরাহ করে থাকে। জনপ্রতিনিধিগণ সরকারি কার্যাবলি সম্পর্কে মন্ত্রীদের বিভিন্ন প্রশ্ন করে থাকে। মন্ত্রিগণ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পার্লামেন্টে উপস্থাপন করে। সংবাদপত্র, বেতার প্রভৃতি মাধ্যম থেকে জনগণ আইনসভার কার্যবিবরণী জানতে পারে।

১০. সংযোগ সাধন সংক্রান্ত আইনসভা সরকার ও নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে সংযোগ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা, আইনসভার প্রতিনিধিগণ স্ব-স্ব এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে এবং জনগণের অভাব-অভিযোগ সরকারের সামনে তুলে ধরে। এভাবে আইনসভায় জনমতের প্রতিফলন ঘটে।

১১. রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিতে আইনসভার সদস্যগণ বিভিন্ন বিষয়ে মতামত প্রদান করেন। অনেক সময় সদস্যগণ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একই বিষয় নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কে অবতীর্ণ হন। সেগুলো সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার হওয়ায় জনগণের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে।

১২. বিচারকদের পদচ্যুতি অনেক সময় আইনসভা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি বা অসদাচরণের অভিযোগের বিচার করে তাদের পদচ্যুত করতে পারে। কোনো কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এরূপ পদ্ধতিতে বিচারকদের অভিশংসন বা অপসারণ করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে এ ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।

১৩. শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ আইনসভার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা। আইনসভার এরূপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শাসন বিভাগের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করা সম্ভব হয়। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বা নির্বাহী বিভাগকে তাদের যাবতীয় কার্যের জন্য একক ও যৌথভাবে আইন পরিষদের নিকট জবাবদিহি করতে হয়। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, পরিপূরক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, নিন্দা প্রস্তাব, মুলতবি প্রস্তাব ইত্যাদি পদ্ধতির মাধ্যমে আইনসভা শাসনবিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

১৪. জনমত গঠন সংক্রান্ত কাজ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইনসভা জনমত গঠনের বাহন হিসেবে কাজ করে। আইনসভার সদস্যগণ পার্লামেন্টে যে বক্তৃতা-বিবৃতি দেন তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। অনেক সময় বিজ্ঞ সদস্যদের সমালোচনা শুনে জনগণ সরকারি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে। এতে আইনসভার ভেতরে ও বাইরে জনমত গঠিত হয়।

১৫. সমালোচনামূলক কাজ: গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আইনসভা জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করে। এ উদ্দেশ্যে আইনসভা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে। পাশাপাশি বিরোধী সদস্যরা কঠোর সমালোচনায় অবতীর্ণ হয়।

উল্লিখিত আলোচনার নিরিখে বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হিসেবে বহুমুখী কার্য সম্পাদন করে থাকে। তাই অধ্যাপক গিলক্রাইস্ট বলেন, "শাসন বিভাগ বা বিচার বিভাগ অপেক্ষা আইন বিভাগ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।" ("The legislature is more important than the executive or judiciary.") কারণ প্রত্যেক দেশের মেরুদণ্ড হলো আইন। আর আইনসভার মাধ্যমেই এ আইন প্রণীত হয়।'

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ