- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
সরকার কাঠামো ও সরকারের অঙ্গসমূহ
আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার কারণ Causes of Reducing Power of Legislature
আইনসভা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে আইনসভার মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে থাকে। সম্প্রতি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভবের ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আইনসভার ক্ষমতা ও ভূমিকা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। গণতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক উভয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ই আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়।
প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বিভিন্ন দেশের সংসদীয় কার্যক্রম পর্যালোচনাপূর্বক আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তিনি 'Modern Democracies' গ্রন্থে আইনসভার ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাসের কারণসমূহ তুলে ধরেছেন। নিচে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
১. জনকল্যাণমূলক কাজের সম্প্রসারণ: সাম্প্রতিককালে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনকল্যাণমূলক কাজের সম্প্রসারণের ফলে শাসন বিভাগের দায়িত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরূপ সেবামূলক কর্মকাণ্ডের দায়িত্বের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে আইনসভা ক্রমবর্ধমান দায়িত্ব পালন করতে পারে না। এজন্য শাসন বিভাগকেই এসব বিষয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হয়। এর ফলে শাসন বিভাগের সাথে জনসাধারণের ব্যক্তিগত ও দৈনন্দিন জীবনের গভীর সংযোগ সাধিত হয়। এ সুবাদে শাসন বিভাগ অধিক ক্ষমতার চর্চার সুযোগ লাভ করে।
২. জরুরি অবস্থা ও সংকটকালীন প্রয়োজন: আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর সমস্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ, আন্তর্জাতিক ঠাণ্ডা লড়াই, নিত্যনতুন সংকট ও আশঙ্কা, অর্থনৈতিক ও বহিঃবাণিজ্যিক সমস্যা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মোকাবেলার দায়-দায়িত্ব শাসন বিভাগকে গ্রহণ করতে হয়। আইনসভায় বিভিন্ন আদর্শ ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব থাকায় ঐ সব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।
৩. দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা মূলত সরকারের আজ্ঞাবহ সংস্থায় পরিণত হয়েছে। অনেকে সংসদকে 'রাবার স্ট্যাম্প' বলে মন্তব্য করেছেন। সুগঠিত দলীয় ব্যবস্থা, কঠোর দলীয় শৃঙ্খলা ইত্যাদির কারণে মন্ত্রিসভা আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে। সব ক্ষেত্রে দলীয় সদস্যগণ দলীয় নেতাদের মতামতকে সমর্থন করে থাকেন। এতে আইনসভা কার্যত নামসর্বস্ব সংস্থায় পরিণত হয়।
৪. সদস্যদের অযোগ্যতা: আধুনিককালে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে আইনসভার সদস্যগণ জটিল কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ে আইন প্রণয়নে অক্ষম। বর্তমানকালে আইন প্রণয়ন মূলত বিশেষজ্ঞদের কাজে পরিণত হয়েছে। এজন্য আইনসভার সদস্যগণ শুধু আইনের মূলনীতি প্রণয়ন করেন আর বিস্তৃত আইন প্রণয়নের দায়িত্ব বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেন। এতে আইনসভার গুরুত্ব হ্রাস পায়।
৫. অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুবিধ আইনের প্রয়োজন হয়। আইনের জটিলতা, আইনসভার সদস্যদের জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব, সর্বোপরি সময়ের অভাবের জন্য আইনসভা আইন প্রণয়নের কিছু ক্ষমতা শাসন বিভাগের ওপর অর্পণ করে। ফলে শাসন বিভাগকে কিছু কিছু আইন প্রণয়ন করতে হয় বলে একে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত (Delegated Lagislation) আইন বলে।
৬. বিরোধ মীমাংসায় ব্যর্থতা আইনসভা মূলত একটি আলোচনামূলক সংস্থা। এতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির পরস্পর বিরোধী স্বার্থের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আর এসব স্বার্থগত বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে আইনসভা ব্যর্থ।
৭. জনমত গঠনে ব্যর্থতা: জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার এবং জনমত গঠনের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানকালে আইনসভা এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম তথা বেতার, দূরদর্শন, সংবাদপত্র প্রভৃতি মাধ্যমগুলো জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ কারণে আইনসভার মর্যাদার হানি ঘটছে।
৮. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা: আইনসভায় যেসব আইন গৃহীত হয় সেগুলোর সাংবিধানিক বৈধতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার অধিকার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনসভা প্রণীত যেকোনো আইনকে সংবিধানের বহির্ভূত হলে বাতিল ঘোষণা করতে পারে। এতে আইনসভার মর্যাদা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়।
৯. সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতা: তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নতুন শাসন পদ্ধতি হিসেবে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অভাবে সংসদীয় ব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ফলে আইনসভার ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে।
১০. শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার সমস্যা: আধুনিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি বৃদ্ধি পাওয়ায় আইনসভা শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এখন আর গতানুগতিক পদ্ধতিতে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
১১. চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর গুরুত্ব: রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সমাজে অনেক স্বার্থগোষ্ঠীর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় যারা শ্রেণি স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অন্যকথায়, সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করার এবং সরকারের সাথে জনসাধারণের সংযোগ সাধনের মাধ্যম হিসেবে এ গোষ্ঠীগুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আইনসভার মর্যাদাহানি ঘটেছে।
১২. গণ-সংযোগের অভাব উদারনৈতিক শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগই নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে। এ সূত্রে নানাভাবে শাসন বিভাগ জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ ও অভাব-অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ত হয়। এর ফলে শাসন বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। সেইসাথে আইনসভার গুরুত্ব হ্রাস পায়।
১৩. সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ: তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুবাদে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করছে। ফলে নির্বাচিত আইনসভার ভূমিকা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। কারণ সামরিক সরকার ইচ্ছামতো দেশ পরিচালনা করে। সেখানে নির্বাচিত আইনসভার কোনো ভূমিকা থাকে না।
উপর্যুক্ত বিশদ আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, কতকগুলো বাস্তব কারণে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তবে একথাও সত্য যে, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইনসভার আস্থা হারালে শাসন বিভাগ তথা মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। আইনসভার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচকমণ্ডলীর সমর্থন থাকলে সরকার বা শাসন বিভাগ আইনসভাকে উপেক্ষা করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, সকল দেশের আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে একথা বলা যায় না। তবে আধুনিক রাষ্ট্রের আইনসভাগুলো তাদের পূর্বের গৌরব ও প্রতিপত্তি বহুলাংশে হারিয়েছে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ