• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
ব্রিটিশ ভারতে প্রতিনিধিত্বশীল

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

ব্রিটিশ ভারতে প্রতিনিধিত্বশীল

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রবর্তিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কার্যকারিতা

সাধারণভাবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলতে বোঝায় সাংবিধানিক কাঠামোয় সুনির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে প্রদেশের নিজস্ব শাসন ক্ষমতা। এটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা সংবিধানের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়, যাতে প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ মুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারে। সুতরাং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলতে সাংবিধানিক উপায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে প্রাদেশিক সরকারগুলোকে নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করার ক্ষমতা প্রদানকে বোঝায়।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারণা তিনটি মৌলিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। যথা:

১. আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করবে। শাসনতন্ত্র অনুযায়ী প্রাদেশিক সরকারের হাতে যেসব বিষয়ের শাসনভার থাকবে সেগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় সরকার কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

২. প্রদেশে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এ অবস্থায় প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদ তাদের সকল কাজের জন্য প্রাদেশিক আইনসভার নিকট দায়ী থাকে।

৩. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রদেশগুলো যথাসম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল হবে। রাজস্ব বণ্টন ও জাতীয় সম্পদ এমনভাবে হবে, যাতে কোনো প্রদেশকে অর্থের জন্য কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী না হতে হয়।

উল্লিখিত তিনটি মৌলিক ধারণা থেকে বলা চলে, ভারতে সর্বপ্রথম ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হয়। এ আইনের দ্বারা প্রদেশগুলোতে ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কার্যকর করা হয়েছিল। এ আইন অনুসারে সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বিষয়সমূহকে সুস্পষ্টভাবে শ্রেণিবিভাগ করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক বিষয়গুলোর ওপর সাধারণত কোনোরূপ হস্তক্ষেপ (Interfere) করবে না তাও স্থির করা হয়। প্রাদেশিক বিষয়সমূহ মন্ত্রিদের হাতে ন্যস্ত করা হয় এবং তাদের এ কাজের জন্য প্রাদেশিক আইনসভার নিকট দায়ী করা হয়। সুতরাং এ কথা বলা যায়, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করা হয়।

কিন্তু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মৌলিক নীতিগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রবর্তিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পূর্ণাঙ্গ ছিল না। নিম্নলিখিত বিষয় আলোচনা করলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে:

১. প্রাদেশিক আইনসভার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা: ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক আইনসভার ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। গভর্নর প্রাদেশিক আইনসভার অধিবেশন আহ্বান ও স্থগিত রাখতে পারতেন। বিলে ভেটো প্রয়োগ ও অর্ডিন্যান্স জারি করার মতো ব্যাপক ক্ষমতা গভর্নরের ছিল। এমনকি তিনি আইনসভাকে অগ্রাহ্য করতে পারতেন। এটি নিঃসন্দেহে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা তথা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মৌলিক নীতির পরিপন্থি।

২. প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা সীমিত এ আইনের মাধ্যমে প্রাদেশিক সরকারগুলো যে শুধু কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল তা নয়, প্রদেশে প্রকৃত দায়িত্বশীল সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা তাদের কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী ছিলেন বটে, কিন্তু মন্ত্রিসভার ক্ষমতা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। প্রকৃত শাসন ক্ষমতা ছিল গভর্নরের হাতে। তিনি মন্ত্রিদের সাথে পরামর্শ না করেই অনেক ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে কাজ করতেন এবং অনেক ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্ব পালনের অজুহাতে মন্ত্রিদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে স্বীয় বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করতেন। এতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত সীমিত যা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থি।

৩. গভর্নর জেনারেলের নির্দেশ: ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ১২৬ ধারা অনুসারে গভর্নর জেনারেল ভারতে শান্তি ও শৃঙ্খলার উদ্দেশ্যে গভর্নরের নিকট নির্দেশ পাঠাতে পারতেন। এ সকল নির্দেশ পালন গভর্নরের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। এভাবে গভর্নর জেনারেল শান্তি-শৃঙ্খলার অজুহাতে প্রদেশের শাসনকার্যে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন।

৪. প্রদেশগুলোর আর্থিক সচ্ছলতার অভাব: আর্থিক ক্ষেত্রেও প্রদেশগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। সরকারি রাজস্বের যে অংশ প্রদেশগুলোকে দেওয়া হতো তা তাদের কার্য ও দায়িত্বের অনুপাতে পর্যাপ্ত ছিল না। এ কারণে অর্থের জন্য অনেক প্রদেশকে কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী থাকতে হতো। এর ফলে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসনে প্রবর্তিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কার্যকর হতে পারে নি।

৫. যুগ্ম তালিকার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের প্রাধান্য: ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়গুলোর ওপর আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেন্দ্র ও প্রদেশের ওপর ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়গুলোর ওপর প্রাদেশিক সরকারের কোনো ক্ষমতা ছিল না বললেই চলে। এ বিষয়ে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিলে কেন্দ্রের আইন বা মতামত প্রাধান্য পেত।

৬. আর্থিক বিষয়ে গভর্নরের অপ্রতিহত ক্ষমতা কর ধার্য ও অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও প্রাদেশিক আইনসভার ক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত। এক্ষেত্রেও গভর্নরের আধিপত্য ছিল ব্যাপক। তিনি প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক বাতিলকৃত ব্যয় বরাদ্দকে পুনর্বহাল করতে পারতেন।

৭. উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ: ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রদেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রাদেশিক সরকারের কোনোরূপ ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব ছিল না। এ সকল কর্মচারী ভারত সচিব কর্তৃক নিয়োগ লাভ করতেন এবং তাদের চাকরির শর্তাবলিও তিনিই স্থির করতেন। এ সব সরকারি কর্মচারী প্রাদেশিক প্রশাসনের চাবিকাঠি হওয়া সত্ত্বেও তাদের ওপর প্রাদেশিক সরকারের কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এ কারণে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হয়।

৮. প্রাদেশিক আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রেও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল অর্থহীন। পুলিশ বিভাগের অভ্যন্তরীণ সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। আইন-শৃঙ্খলা বিভাগ সম্পূর্ণরূপে গভর্নরের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এ কারণে প্রদেশে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা কার্যকর হতে পারেনি।

৯. গভর্নর জেনারেলের জরুরি অবস্থা ঘোষণা গভর্নর জেনারেল জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে স্থগিত রাখতে পারতেন। এমনকি তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভাকে প্রাদেশিক বিষয়ে আইন প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করতে পারতেন। জরুরি অবস্থায় গভর্নর জেনারেল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠতেন এবং তার স্বীয় কার্যের জন্য কারো নিকট জবাবদিহি করতে হতো না। এ কারণে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রবর্তিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।

১০. রাজা বা রানির হস্তক্ষেপ এ আইনে প্রাদেশিক আইনসভায় গৃহীত এবং গভর্নরের সম্মতিপ্রাপ্ত বিল ব্রিটিশ রাজা বা রানি নাকচ করে দিতে পারতেন।

১১. গভর্নরের আইন ও জরুরি আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা গভর্নরগণ প্রাদেশিক আইনসভার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গভর্নরের আইন (Governor's Act) এবং জরুরি আইন (Emergency Ordinance) জারি করতে পারতেন। গভর্নরগণ যেকোনো অজুহাতে প্রাদেশিক আইনসভার কর্তৃত্বকে উপেক্ষা করতে পারতেন। এ কারণে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কার্যকর হতে পারেনি।

আলোচনা শেষে বলা যায়, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী প্রবর্তিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা ছিল অকার্যকর ও অপূর্ণাঙ্গ। এ আইন প্রদেশে দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রবর্তনে ব্যর্থ হয়। গভর্নর জেনারেল এবং গভর্নরের সীমাহীন ক্ষমতা ও প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ এত বেশি ছিল যে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রহসনে পরিণত হয়।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ