- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
ব্রিটিশ ভারতে প্রতিনিধিত্বশীল
গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা ও কার্যাবলি
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে গভর্নর জেনারেলের পদটি ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এ আইন অনুসারে একজন গভর্নর জেনারেল, তাঁর উপদেষ্টাবৃন্দ ও একটি মন্ত্রিসভা নিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন বিভাগ গঠিত হতো। কেন্দ্রীয় ও যুগ্মতালিকাভুক্ত বিষয়সমূহের ওপর তার কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্যাপক ও অপ্রতিহত। এছাড়া জরুরি অবস্থা চলাকালে তার কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রাদেশিক তালিকাভুক্ত বিষয়সমূহের ওপরও কার্যকর হতো।
নিয়োগ ও কার্যকাল: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং ভারত সচিবের পরামর্শ অনুযায়ী ব্রিটেনের রাজা বা রানি কর্তৃক গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হতেন। তার কার্যকাল ছিল ৫ বছর। তার সকল কর্মকাণ্ডের জন্য ভারত সচিবের মাধ্যমে তিনি একমাত্র ব্রিটিশ পার্লামেন্টের (Parliament) নিকট দায়ী ছিলেন।
পদমর্যাদা: ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী প্রস্তাবিত সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় গভর্নর জেনারেল ছিলেন শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু (Cornerstone), চূড়ান্ত অর্থে ভারতের সমুদয় শাসন পরিচালনার দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত ছিল। তিনি * ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রকৃত প্রধান এবং তার নামে শাসনকার্য পরিচালিত হতো। তিনি যেকোনো ভারতীয় আদালতের বিচারের ঊর্ধ্বে ছিলেন। গভর্নর জেনারেল ব্রিটিশ রাজা বা রানির নিকট থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনামা (Instrument of Instructions) অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা ও কার্যাবলি ছিল নিম্নরূপ-
১. শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা: শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গভর্নর জেনারেল ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তার শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতাকে নিম্নলিখিত তিনটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা হলো:
(ক) স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা: মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ না করে গভর্নর জেনারেল যে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতেন সেগুলোকে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা (Discretionary Powers) বলে। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, ধর্মীয় এবং উপজাতীয় এলাকা সংক্রান্ত বিষয় তার হাতে সংরক্ষিত ছিল। এ সকল বিষয় তিনি স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বলে শাসন করতেন। তার এসব বিষয় পরিচালনায় ৩ জন উপদেষ্টা সাহায্য করতেন। উপদেষ্টাগণ তার কাছে দায়ী ছিলেন এবং তার দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বলে তিনি তার উপদেষ্টা, অডিটর জেনারেল, ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর, অ্যাডভোকেট জেনারেল, ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, ভারতের হাই-কমিশনার, হাইকোর্ট ও ফেডারেল কোর্টের বিচারপতি প্রভৃতি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ করতে পারতেন।
(খ) ব্যক্তিগত বিবেচনাধীন ক্ষমতা ও বিশেষ দায়িত্ব: মন্ত্রিসভার সাথে পরামর্শ করলে সে পরামর্শ বা উপদেশ অগ্রাহ্য করে গভর্নর জেনারেল যে সকল বিষয়ে স্বীয় বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করতে পারতেন সেগুলোকে ব্যক্তিগত বিবেচনাধীন ক্ষমতা (Power of Individual Judgement) বলে। নিম্নলিখিত বিষয়ে গভর্নর জেনারেল স্বীয়
বিবেচনাধীন ক্ষমতা ও বিশেষ দায়িত্ব প্রয়োগ করতেন।
(১) ভারতবর্ষ বা এর যেকোনো অংশে শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গের যেকোনো হুমকি নিবৃত্ত করা।
(২) যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার তথা ভারতের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মর্যাদা রক্ষা করা।
(৩) সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বৈধ অধিকার সংরক্ষণ করা।
(৪) সরকারি কর্মচারীদের আইনসংগত অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ করা।
(৫) ব্রিটেন ও বার্মা (মায়ানমার) হতে আমদানিকৃত দ্রব্যের ওপর কোনো বৈষম্যমূলক কর আরোপ বন্ধ করা।
(৬) ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণ এবং দেশীয় রাজ্যের শাসকদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা।
(৭) ব্রিটিশ নাগরিকদের বাণিজ্যিক বৈষম্য দূর করা।
(৮) বিভেদ সৃষ্টিমূলক আইনকে প্রতিহত করা।
( গ) মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে ব্যবহৃত ক্ষমতা গভর্নর জেনারেল যে সকল বিষয়ে মন্ত্রিসভার পরামর্শ গ্রহণ করতেন সেগুলো ছিল তার এ ধরনের ক্ষমতার এখতিয়ারভুক্ত। সাধারণত তিনি হস্তান্তরিত বিষয়াদি পরিচালনার ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার পরামর্শ গ্রহণ করতেন। শাসনকার্য পরিচালনায় তিনি অনধিক ১০ জন সদস্য নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতেন এবং তাদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করতেন। এদের তিনি নিযুক্ত এবং প্রয়োজনে পদচ্যুত করতে পারতেন।
২. আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেলের অনেক ক্ষমতা ছিল। তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভার যেকোনো অধিবেশন আহ্বান করতে এবং স্থগিত রাখতে পারতেন। এমনকি তিনি নিম্নকক্ষ ভেঙেও দিতে পারতেন। তিনি আইনসভায় ভাষণ বা বাণী (Message) প্রেরণ করতে পারতেন। তার অনুমোদন ছাড়া কোনো বিল আইনে পরিণত হতো না। আইনসভা কর্তৃক অনুমোদিত কোনো বিলে তিনি সম্মতি দিতে, সম্মতি স্থগিত বা পুনর্বিবেচনার জন্য আইনসভায় ফেরত পাঠাতে পারতেন অথবা রাজকীয় অনুমোদনের জন্য সংরক্ষিত রাখতে পারতেন।
গভর্নর জেনারেল তার ইচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যেকোনো সময় 'জরুরি আইন' (Emergency Ordinance) জারি করতে পারতেন। এ জরুরি আইন ৬ মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকত। এছাড়া গভর্নর জেনারেল তার 'বিশেষ দায়িত্ব' পালনের জন্য 'গভর্নর জেনারেলের আইন' (Governor General's Act) নামে এক বিশেষ আইন প্রণয়ন করতে পারতেন। তাই দেখা যায়, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা ছিল অসীম।
৩. অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতা গভর্নর জেনারেলের অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। গভর্নর জেনারেল প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রদর্শন করে একটি বাজেট আইনসভায় পেশ করতেন। এ বাজেটে কিছু ভোটযোগ্য এবং কিছু ভোট বহির্ভূত বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভোট বহির্ভূত তথা সংরক্ষিত বিষয়গুলো সম্পর্কে ব্যয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ গভর্নর জেনারেল নিজেই নির্ধারণ করতেন, যা মোট বাজেটের ৮০ ভাগ ছিল। অবশিষ্ট ২০ ভাগ ভোটযোগ্য বিষয়সমূহ 'বরাদ্দ দাবি' হিসেবে গভর্নর জেনারেলের অনুমতি সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় আইনসভায় উপস্থাপন করা হতো। আইনসভা কোনো বরাদ্দ দাবি প্রত্যাখ্যান করলে বা কোনো দাবির পরিমাণ হ্রাস করলে গভর্নর জেনারেল তা পুনর্বহাল করতে পারতেন।
৪. প্রদেশসমূহের ওপর নিয়ন্ত্রণ: ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে গভর্নর জেনারেল প্রদেশগুলোর ওপর তার কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারতেন। প্রাদেশিক গভর্নরগণ তার নির্দেশ অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করতেন। গভর্নর জেনারেল শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে প্রাদেশিক সরকারের ওপর যেকোনো আদেশ জারি করতে পারতেন। এছাড়া প্রাদেশিক গভর্নর যখন তার ইচ্ছাধীন ও ব্যক্তিগত বিবেচনাধীন ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতেন, তখন তাকে তার কাজের জন্য গভর্নর জেনারেলের নিকট দায়ী থাকতে হতো। উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে গভর্নর জেনারেল ছিলেন সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী এক মহাপরাক্রমশালী শাসক। শাসন, আইন ও আর্থিক সকল ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা ছিল অপ্রতিহত। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ