• হোম
  • স্কুল ১-১২
  • সাধারণ
  • অষ্টম শ্রেণি

প্রবন্ধ রচনা

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

প্রবন্ধ রচনা

স্বদেশপ্রেম অথবা স্বদেশপ্রীতি অথবা জাতীয় জীবনে দেশপ্রেমের গুরুত্ব অথবা দেশপ্রেম

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে-
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে-
কে পরিবে পায়?- রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়

ভূমিকা: স্বাধীনতাহীন জীবন কোনো মানুষের কাম্য নয়। স্বদেশের বুকে প্রত্যেক মানুষ স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে চায়। তাই দেশপ্রেমিক জনগণ স্বদেশকে মুক্ত রাখতে সদাতৎপর। কারণ হৃদয়ের গভীর থেকে অকৃত্রিম অনুরাগে নিজের দেশ, দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসাই হচ্ছে স্বদেশপ্রেম। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে এ অনুভব উজ্জ্বল আলোর মতো জেগে থাকে। স্বদেশের প্রতি যে মানুষের ভালোবাসা নেই, তার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। আমরা স্বদেশের কোলে লালিত-পালিত হয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠি। স্বদেশের আলো-জল-মাটির স্পর্শে আমাদের দেহ-মন পরিপুষ্ট হয়। সারাটা জীবন মানুষ স্বদেশের বুকে গৌরবের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে চায় এবং স্বদেশের বুকে যেন মৃত্যু হয় এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করে। তাই তো কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একজন দেশপ্রেমিকের উপলব্ধি ও চেতনাকে তাঁর কবিতায় প্রোথিত করেছেন-

"ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম- যেন এই দেশেতেই মরি-"

স্বদেশপ্রেম কী: সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা মানুষের ধর্ম। সমাজ আবার কতকগুলো নির্দিষ্ট ভাষা, ধর্ম ও অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমায় বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে পৃথক বা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বা জাতিতে বিভক্ত। জাতির এই স্বাতন্ত্র্যবোধ তখনই তীব্র হয় যখন বিশেষ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ঐক্যচেতনা জাগ্রত হয়। এ ঐক্যচেতনার নামই স্বদেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ বা দেশাত্মবোধ। প্রকৃতপক্ষে স্বদেশের ভৌগোলিক সীমা, তার ঐতিহ্য, ইতিহাস, ভাষা, প্রাকৃতিক সম্পদ, ধর্মবোধ প্রভৃতি নিয়ে স্বদেশপ্রেমকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। মাতৃভূমি বা স্বদেশকে নিজের বলে মনে করা কিংবা স্বদেশের মাটি-মানুষ সবকিছুকে আপন মনে করা একজন দেশপ্রেমিক মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্য। মূলত মানুষের এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় স্বদেশপ্রেম।

স্বদেশপ্রেমের ধরন: দেশকে ভালোবাসার মধ্যেই দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ নয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উন্নত জাতির কাছে দেশের স্থান সবার ওপরে। দেশের কল্যাণে সর্বস্ব ত্যাগের নজির পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জাতির মধ্যেই বিদ্যমান। প্রত্যেক দেশপ্রেমিক মানুষ দেশের সংকটে-দুর্যোগে, বিপদে-আপদে সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশের সেবা করে। কারণ মানুষ জানে, দেশ ভালো থাকলে দেশের মানুষও ভালো থাকবে। তাই দেশের অসম্মান, অপমান প্রভৃতির হাত থেকে দেশকে মুক্ত রাখা প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। এজন্য যারা দেশকে অসম্মান কিংবা অপমান করে তাদেরকে সবাই ঘৃণা করে। দেশপ্রেম হলো জাতীয় উন্নতির প্রধান উপায়।

জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী সংস্কৃত কবিরা বলেছেন জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। জন্মের পর জননীর মতো জন্মভূমিও তার 'স্তন্যে-স্নেহে' আমাদের লালন-পালন করে এবং সব মানুষকে অন্ন দান করে বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। তাই জন্মভূমি সব মানুষের কাছে জননীর মতোই শ্রেষ্ঠ। জন্মভূমির এই শ্রেষ্ঠত্ব ধরা পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে-

ও আমার দেশের মাটি
তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা।...
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে,
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে সকল সহা সকল বহা মাতার মাতা।

দেশপ্রেমিকের অবদান দেশের অভ্যন্তরে বসবাসরত প্রত্যেক মানুষ দেশকে ভালোবাসে। তবে কিছু মানুষ যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁদের কর্মময় জীবনের মহান দৃষ্টান্ত স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক মানুষ দেশের স্বার্থে সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, লেনিন, মাওসেতুং, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ নেতা দেশকে ভালোবেসে দীর্ঘকাল কারাবরণ করেছেন। শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার আর নির্মম পীড়ন সহ্য করেও তাঁরা দেশ ও জাতির মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সমগ্র মানুষ বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে।বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলত ত্রিশ লক্ষ শহিদ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেমের চূড়ান্ত ফসল।

দেশপ্রেম জাগরণে সাহিত্য স্বদেশপ্রেম কেবল ইতিহাস, ঐতিহ্য, মনীষীদের বাণী বা ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলা সাহিত্যে ও বিশ্বসাহিত্যে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার সমূহ ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তাঁর 'নূরনামা' কাব্যের 'বঙ্গবাণী' কবিতায় দেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও ভালোবাসার কথা দ্বিধাহীনচিত্তে ব্যক্ত করেছেন। যারা দেশকে ভালোবাসে না তাদের প্রতি তিনি ধিক্কার জানিয়ে লিখেছেন- "যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।" জানি। কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলাদেশকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে বলেছেন-"বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।" কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রূপময় বাংলার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে গেয়ে ওঠেন- "ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা।" বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশকে অন্তরে লালন করে লিখেছেন- "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।"

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণে আমাদের করণীয়: দেশপ্রেমের আকুলতা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে একই সুতায় গাঁথা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের আচার-আচরণ আলাদা হলেও দেশপ্রেমের প্রকৃতি একই রকম। জাতীয় জীবনে প্রত্যেক মানুষ স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত। একমাত্র স্বার্থহীন দেশপ্রেম যেকোনো জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে পারে। স্বার্থহীন দেশপ্রেমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের ভাষা আন্দোলন। মাতৃভূমির প্রতি বাংলার মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণেই বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীনতা। বাংলার মানুষ যেকোনো মূল্যে স্বদেশের সম্মান সমুন্নত রাখতে সদা প্রস্তুত- ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ এর জ্বলন্ত প্রমাণ।

দেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম: স্বার্থহীন প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মনে কখনো সংকীর্ণতা দানা বাঁধতে পারে না। স্বদেশকে ভালোবাসা নৈতিক দায়িত্ব, কিন্তু অন্য দেশের প্রতি বিদ্বেষ ভাব পোষণ করাও উচিত নয়। যে দেশপ্রেম শুধু নিজের দেশের জন্য সে দেশপ্রেম কখনো প্রকৃত দেশপ্রেম নয়। স্বদেশের গন্ডি অতিক্রম করে গোটা বিশ্বকে একটা দেশ ভাবতে পারা প্রকৃত দেশপ্রেমিকের লক্ষণ। তাই নিজের দেশকেও ভালোবাসতে হবে এবং পুরো বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতি সহমর্মিতা জাগ্রত রাখতে হবে। কারণ প্রকৃত দেশপ্রেমিক কখনো নিজেকে গুটিয়ে রাখেন না, সমগ্র বিশ্বে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়াকেই সার্থকতা মনে করেন।

উপসংহার: স্বদেশের প্রতি যার ভালোবাসা নেই সে পশুর সমান। স্বদেশপ্রেম মানুষের জীবনের অন্যতম মহৎ চেতনা। এটি মানুষকে ধর্ম-বর্ণ, জাতিগত সমস্ত সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত রাখে। যথার্থ দেশপ্রেমিক নিজ স্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশকে স্থান দেন। তাই আমাদের সবার উচিত স্বার্থহীন দেশপ্রেমের চর্চা করা। কেবল কথায় নয়, মেধা-মননে, চিন্তা-চেতনায়, কর্মে দেশপ্রেমকে স্থান দিতে হবে। তবেই আমাদের বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হবে।