• হোম
  • স্কুল ১-১২
  • সাধারণ
  • অষ্টম শ্রেণি

প্রবন্ধ রচনা

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

প্রবন্ধ রচনা

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অথবা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বাংলাদেশ

ভূমিকা: পৃথিবীর যেসব দেশে সাম্প্রদায়িক বিরোধ রয়েছে তার মূলে আছে উগ্র মৌলবাদ। দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে এই সাম্প্রদায়িক বিরোধ যে কত মানুষের প্রাণ হরণ করেছে তার কোন হিসাব নেই। আজ বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের হিংসা-বিদ্বেষের ফলে বিশ্বে মানবতাবোধ লোপ পাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাই সাম্প্রদায়িকতার মূল' কথা। অথচ সকল ধর্মেরই মূল কথা প্রেম, মৈত্রী ও করুণা- যা সকল প্রকার প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরোধী। সাধারণভাবে পৃথিবীর মানুষ নানা ধর্মসম্প্রদায়ে বিভক্ত হলেও সকল মানুষের সৃষ্টির উৎস এক। তাছাড়া মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টিকুলের মধ্যে কেবল মানুষই বুদ্ধি-বিবেচনায় ও সচেতনতায় শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বকে বজায় রাখতে হলে মানুষকে হতে হবে বিবেকবান ও মানবতাবাদী, চলতে হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে। তবে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হবে।

সাম্প্রদায়িকতার অপকারিতা: ইংরেজ শাসনের সূচনাপর্বে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেছিল। তার ভয়াবহ বিষক্রিয়ায় জাতীয় জীবন হয়ে পড়েছিল মুমূর্ষু, দুর্বল হয়ে পড়েছিল সমাজদেহ। ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত এদেশের ইতিহাসে 'সাম্প্রদায়িকতা' শব্দটি যুক্ত হয়নি। ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর মানুষ আবার জীবনের গতি ফিরে পেয়েছিল। জীবন হয়েছে গতিশীল। প্রগতিই হলো গতির চালিকাশক্তি। এ যাত্রাপথে পাড়ি দিতে হলে মানুষকে ভ্রাতৃত্ব বা সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে।

সামাজিক জীবন হিসেবে সর্বোৎকৃষ্ট সমাজ গঠনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে রাখে। সমাজ প্রগতির পথ রুদ্ধ করে দেয়। কোনো ধর্ম, কোনো আদর্শই পৃথিবীতে এ সর্বনাশা ভেদবুদ্ধি সমর্থন করেনি। ইসলাম ধর্মে জোর দিয়ে বলা হয়েছে- "ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।" এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবই সাম্প্রদায়িকতার জনক। সাধারণভাবে একই ধর্মসম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ, অভিন্ন-এই ধারণা থেকেই সাম্প্রদায়িকতাবোধের জন্ম হয়েছে। এই মনোভাব সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি প্রণোদিত, এর অপকারিতার শেষ নেই, কোনো সুস্থ চেতনাসম্পন্ন মানুষ তা সমর্থন করতে পারে না।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই মুক্তির পথ প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা দুটি স্বতন্ত্র বিষয়। ধর্মের লক্ষ্য পারত্রিক কল্যাণ, আর সাম্প্রদায়িকতার লক্ষ্য অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ও ঐহিক সমৃদ্ধি। এসব কথা ভুলে আজ আমাদের জাতীয় জীবনে গঠনমূলক কাজের উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। চাষি, জেলে, কামার, কুমার, মুচি, জোলা, ডোম, ধাঙ্গর সকলকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেই জাতির উন্নয়নের, জন্যে গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলা একটি অপরিহার্য বিষয়। এই অনুভব থেকেই কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন-

জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
সে জাতির নাম মানুষ জাতি।
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
একই রবি শশী মোদের সাথি।

দেশ, জাতি ও বিশ্বসমাজ গঠনে সম্প্রীতি সমাজে প্রতিটি মানুষ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। একজনের সহায়তা ছাড়া অন্যজনের সমাজ জীবন চলতে পারে না। এজন্যেই পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি বা মধুর সম্পর্ক থাকা দরকার। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শুধু নিজের দেশ ও 'জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয় নয়, বিশ্ব সমাজ গঠনের জন্যেও বাঞ্ছনীয়।

অতীতে আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে পৃথিবীতে বহু যুদ্ধবিগ্রহ, সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে। সেসব ইতিহাসের কথা ভুলে গিয়ে, বিশ্বজনীন সামাজিক সম্প্রীতি তথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করেই সমগ্র বিশ্বে শান্তি ও প্রগতি স্থাপন করা যায়। এই সম্প্রীতিই কেবল মানবজীবনের শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের গ্যারান্টি দিতে পারে। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সকলের কাম্য হওয়া উচিত। এই অনুভব থেকেই কবি আবদুল কাদির তাঁর, 'মৈত্রী' কবিতায় বলেছেন-

হিংসা-দ্বেষ রহিবে না, কেহ কারে করিবে না ঘৃণা,
পরস্পরে বাঁধি' দিব প্রীতির বন্ধনে,
বিশ্বজুড়ে এক সুরে বাজিবে গো মিলনের বীণা
মানব জাগিবে নব-জীবন স্পন্দনে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বাংলাদেশ: বাংলাদেশকে বলা হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পীঠস্থান। প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের সুনাম আছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে। এটা আমাদের গৌরব। প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতে এ পর্যন্ত অসংখ্যবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সংঘটিত হয়েছে। চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এর বিষময় প্রতিফলন ঘটেনি বাংলাদেশের মাটিতে। এখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ দেশের মানুষের সহনশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি। মানুষের মধ্যে সহনশীলতা ও সচেতন মনোবৃত্তি আছে বলেই বাংলাদেশে প্রতিবেশী দেশের চরম সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ড এবং মর্মান্তিক ঘটনাবলির কোন অশুভ প্রতিফলন ঘটেনি।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকলেই মিলেমিশে বসবাস করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি স্পষ্টভাবে স্বীকৃত। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এ সম্প্রীতি সংরক্ষণের পরিস্থিতিটি খুবই উপযোগী। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস। এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহান মন্ত্রে দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল।

উপসংহার: প্রতিটি ধর্মেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের সকল মানুষ যদি পরস্পরকে ভাই হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে আর সাম্প্রদায়িক সংঘাত থাকতে পারে না। এই সংঘাতময় মনোবৃত্তি দূর হলে এমনিতেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রবল হতে পারে। আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হলে সামাজিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জীবন হতে পারে শান্তিময় ও সুন্দর।