- হোম
- স্কুল ১-১২
- সাধারণ
- অষ্টম শ্রেণি
প্রবন্ধ রচনা
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
প্রবন্ধ রচনা
প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও এর প্রতিকার অথবা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বাংলাদেশ অথবা, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা
ভূমিকা: প্রকৃতি একদিকে নির্মাণ করে, অন্যদিকে ধ্বংস করে। প্রকৃতি কখনো শ্যামল-কোমল-স্নিগ্ধ, আবার কখনোবা ভয়ংকর। প্রকৃতি মানুষকে পৃথিবীতে টিকে থাকতে সাহায্য করে, আবার প্রকৃতিই মানুষের আশ্রয় ধ্বংস করে। তবুও জীবনসংগ্রামী মানুষ হার মানে না। বৈরী প্রকৃতিকে জয় করে গড়ে তোলে সভ্যতা, বেঁচে থাকার আশ্রয়। মানুষ প্রকৃতির এ ৰূপে অভ্যস্ত। তাই বারবার বিপর্যস্ত হয়েও তারা আবার উঠে দাঁড়ায়। প্রকৃতির এই নির্মম ধ্বংসাত্মক রূপটিকে আমরা "প্রাকৃতিক দুর্যোগ' বলি। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি। প্রকৃতি এ দেশের মানুষের জন্য যতটা সহায়, অন্য কোনো দেশের জন্য ততটা নয়। তবুও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশের মানুষের জীবন বারবার বিপর্যস্ত করে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ: প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক স্নিগ্ধ-কোমল রূপ রয়েছে। কিন্তু যখনই এ রূপের ব্যতিক্রম ঘটে তখনই শুরু হয় বিভিন্ন রকম দুর্যোগ। এসব দুর্যোগ মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারা ব্যাহত করে এবং জীব-জন্তু, ধন-সম্পদ, পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আক্রান্ত জাতিগোষ্ঠীকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রকৃতির এ ধ্বংসলীলা মোকাবিলা করতে হয়। প্রকৃতির এ ধ্বংসাত্মক রূপকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি প্রধান কারণ এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ। বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর এই তিন দিকে ভারতের স্থলভাগ। হিমালয় ও ভারত থেকে নেমে এসেছে ৫৪টি নদী। তাই ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস এ দেশকে বারবার তছনছ করে দেয়। এছাড়াও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশের ওপর বিভিন্ন প্রভাব পড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, অতিরিক্ত বৃক্ষনিধন, গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি, কলকারখানা বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণে ওজোন স্তর ক্ষয় হয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ: প্রতিবছরই এদেশে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো-
বন্যা: প্রাচীনকাল থেকে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের মানুষ বন্যার শিকার হয়ে আসছে। বন্যা বাংলাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্লাবন বা অতিবর্ষণের ভয়াল রূপ হলো বন্যা। বৃক্ষনিধন, অতিবৃষ্টি, নদীর পানি বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে বন্যা হয়ে থাকে। ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৮, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০০ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। বন্যায় ফসল, রাস্তাঘাট, সেতু, গাছপালা, কাঁচা ঘরবাড়ি প্রভৃতি ধ্বংস হয়।
খরা: বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিকাজের জন্য পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন হয়। এই পানির জন্য বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। বৃষ্টিপাত কম হলে দেশে খরা দেখা দেয়। পানির অভাবে মাঠ-ঘাট শুকিয়ে যায়, ফসল পুড়ে নষ্ট হয়। দেশে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়: সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অল্প পরিসরে হঠাৎ বায়ুর উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বায়ু হালকা হয়ে উপরে উঠে যায় এবং নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। তখন চারদিকের শীতল ও ভারী বায়ু নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে ছুটে যায় এবং ঘুরতে ঘুরতে কেন্দ্রে প্রবেশ করে। এই কেন্দ্রমুখী বায়ুপ্রবাহই সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়। সাইক্লোনের ফলে কেন্দ্রের কাছাকাছি অঞ্চলে সমুদ্রের পানি ফুলে উঠে জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকার মানুষ এ দুর্যোগের শিকার হয়। ১৯৭০, ১৯৯১ এবং ২০০৭ সালের সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়।
কালবৈশাখী: কালবৈশাখী ঝড় বাংলাদেশে প্রতিবছরই আঘাত হানে। বঝড়ের তান্ডবে ধ্বংস হয় গ্রাম, গাছপালা, পশু-পাখি। বজ্রপাতের কারণে মারা যায় বহু মানুষ। বর্তমানে বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দুবছরে বজ্রপাতের ফলে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
শিলাবৃষ্টি: বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টির সঙ্গে ছোট ছোট শক্ত বরফ খন্ড পড়ে, একে শিলাবৃষ্টি বলে। শিলাবৃষ্টির ফলে বিভিন্ন ধরনের ফসল এবং কাঁচা ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়।
নদীভাঙন: বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস। কিন্তু নদীভাঙন এ দেশে একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সর্বনাশা নদীভাঙনে গ্রামের পর গ্রাম রাতারাতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘরবাড়ি, ফসল ও সম্পদ। এ দুর্যোগের কবলে পড়ে মানুষ গৃহহীন হয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করে।
ভূমিকম্প: প্রাচীনকাল থেকে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিকম্পও বাংলাদেশে আঘাত হেনে আসছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল হলো ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা।
লবণাক্ততা: লবণাক্ততাও একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। লবণাক্ততা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সমুদ্রের লবণাক্ত পানির প্রভাবে উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল লবণাক্ত থাকে, ফলে ফসল হয় না।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের মানুষ ভয়াবহরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ দেশ প্রতিবছর কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ও মানবসম্পদ হারাচ্ছে। বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি ছোটখাটো মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, যেমন- অগ্নিকান্ড, ভূমিধস, ভবনধস ইত্যাদি ঘটে থাকে। এসব দুর্যোগ মানবসম্পদসহ অন্যান্য সম্পদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে থাকে এবং দেশের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিকারের উপায়: সঠিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এমনকি ক্ষয়ক্ষতি কমানোও সম্ভব। উপায়গুলো হলো-
- দুর্যোগের বিষয়ে আগে থেকেই সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
- দুর্যোগের পূর্বে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
- পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বৃক্ষরোপণ করতে হবে এবং বৃক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে।
- দুর্যোগকালীন সমস্যা মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মীবাহিনী গঠন করতে হবে।
- জাতীয় ভিত্তিতে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য নীতিমালা, পরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি থাকতে হবে।
- সঠিক উপায়ে জনগণকে দুর্যোগের পূর্বাভাস বা সংকেত দিতে হবে।
- দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।
- প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহে রাখতে হবে।
- উদ্ধার অভিযানে প্রয়োজনীয় যানবাহন, যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
- বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
- বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাকে কাজে লাগাতে হবে।
- সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীকে কাজে লাগাতে হবে।
- অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ করতে হবে।
- পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে।
- নদীর নাব্যতা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি মৃতপ্রায় নদীগুলো নিয়মিত খনন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
- দুর্যোগ মোকাবিলায় নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
- দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন ও ঋণদানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
উপসংহার: প্রকৃতির ওপর মানুষের কোনো আধিপত্য চলে না। কিন্তু মানুষ তার সচেতনতা দিয়ে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। প্রকৃতি মানুষের অনাচারের কারণেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। বিজ্ঞান ও বুদ্ধি প্রয়োগ করে মানুষকে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে। এটা কারও একার কাজ নয় বা সম্ভব নয়। সবাইকে একযোগে দুর্যোগ মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃতি আমাদের সবার, একে ঠিক রাখাও আমাদের সবার দায়িত্ব।