• হোম
  • স্কুল ১-১২
  • সাধারণ
  • অষ্টম শ্রেণি

প্রবন্ধ রচনা

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

প্রবন্ধ রচনা

স্বপ্নের পদ্মা সেতু অথবা, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও পদ্মা সেতু অথবা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পদ্মা সেতুর অবদান

ভূমিকা: বাংলাদেশের সবচেয়ে খরস্রোতা ও প্রশস্ত পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য-অভাবনীয় এক কীর্তি- নতুন এক 'নেশন ব্র্যান্ডিং'। এই সেতু বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সংযোগ ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু খুলে দেবে নতুন সম্ভাবনার অবারিত দুয়ার, উন্নত ও সুখময় হবে মানুষের জীবনযাত্রা। এ দেশের মানুষের উদ্যম ও সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতু। গৌরব, অহংকার ও আত্মমর্যাদার সমুজ্জ্বল প্রতীক পদ্মা সেতু।

অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা: AECOM-এর নকশায় পদ্মা নদীর ওপর 'পদ্মা বহুমুখী সেতু'র নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে এবং শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। পুরো প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯২ কোটি ডলার। এটি নির্মাণে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, আইডিবি ও আবুধাবি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপের ঋণ সহায়তা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরামর্শক নিয়োগে তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগে ২৯ জুন, ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা বাতিল করে। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাও পিছিয়ে যায়। ফলে পদ্মা সেতুর ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিছু সময়ের জন্য এ দেশের মানুষ দুঃখ, ক্ষোভ ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়।

প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্ত: বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখা ও বাস্তবায়নের রূপকার। তারা সাহসী ও সংগ্রামী। প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রত্যয়দীপ্ত এ দেশের মানুষ পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পেরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে আমাদের সরকারও। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা এ দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেন তেজোদীপ্ত কণ্ঠে। তার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী এবং অনন্য ও সাহসী।

পদ্মা সেতুর রূপরেখা: পদ্মা সেতু বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। এ সেতুর নকশা প্রণয়ন করেছে AECOM। এটি মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া প্রান্তের সঙ্গে শরিয়তপুর জেলার জাজিরা প্রান্তের সংযোগ ঘটিয়েছে। দ্বিতল এ সেতু সম্পূর্ণভাবে কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে তৈরি হয়েছে। এর ওপর দিয়ে চলছে যানবাহন এবং নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। চার লেনবিশিষ্ট মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২২ মিটার। দুই প্রান্তে সেতুর ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটার এবং সংযোগ সড়ক ১২ কিলোমিটার। নদীর দুই পাড়ে নদীশাসনের কাজ হয়েছে ১৪ কিলোমিটার। মূল সেতুর মোট পিলার ৪২টি, মোট স্প্যান ৪১টি এবং মোট পাইলিং সংখ্যা ২৬৪। এর উচ্চতা ১৮ মিটার। পদ্মা সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪ জুলাই, ২০০১ সালে। এ সেতুর মূল কাজ শুরু হয়েছে ২৬ নভেম্বর, ২০১৪ সালে এবং শেষ হয়েছে ২৩ জুন, ২০২২। পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ জুন, ২০২২ এবং সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে ২৬ জুন, ২০২২ থেকে।

প্রকল্প ব্যয়: পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রথমে ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। ২০১১ সালে সেতুর নির্মাণ ব্যয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকায় উন্নীত করে একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আবারও ৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। সর্বশেষ আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বেড়ে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতুর বর্ণাঢ্য উদ্বোধন: বিশ্ব ইতিহাসে মাইলফলক পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে প্রাণের উচ্ছ্বাসে পদ্মাপাড় জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ২৫ জুন, ২০২২ বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে সুইচ টিপে পদ্মা সেতুর ফলক উন্মোচন করে সেতুর উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ফলকের স্থানে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ম্যুরাল উন্মোচন করেন। করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে চারদিক। জাজিরার দিকে যাওয়ার পথে তিনি সেতুর ওপর নেমে প্রায় ১৫ মিনিট উপভোগ করেন বিমান ও হেলিকপ্টারের ফ্লাইং ডিসপ্লে। এ সময় মিগ-২৯ জঙ্গি বিমানের প্রদর্শনীও উপভোগ করেন মাননীয় সরকারপ্রধান। ১২টা ৩৫ মিনিটে জাজিরা প্রান্তে পৌছে তিনি পদ্মা সেতুর ফলক উন্মোচন করেন। ১২টা ৫১ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী জনসভাস্থলে পৌছে লক্ষ লক্ষ মানুষের শুভেচ্ছার জবাব দেন এবং তাদের উদ্দেশে সকৃতজ্ঞ ও ইতিবাচক ভাষণ দেন।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও উপযোগিতা অপরিসীম।

নিচে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব তুলে ধরা হলো-

ক. যোগাযোগ ক্ষেত্রে: পদ্মা সেতু চালু হাওয়ার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ খুব সহজে এবং অল্প সময়ে রাজধানী ঢাকায় এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যাতায়াত করতে পারছে। তাদের উৎপাদিত নানা সমাগ্রী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনায়াসে সরবরাহ করতে পারছে। পায়রা ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যোগাযোগের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু হবে সূতিকাগার। এছাড়া বেনাপোল, ভোমরা ও দর্শনা স্থলবন্দরের সঙ্গে বিভিন্ন জেলার মধ্য দিয়ে আন্তর্দেশীয় যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

খ. পর্যটন ক্ষেত্রে: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হবে পর্যটনের উৎকৃষ্ট কেন্দ্র। ছুটি পেলেই মানুষ ছুটে যাবে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থান কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ষাটগম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি, পায়রা সমুদ্রবন্দর পরিদর্শনে।

গ. শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর এপার-ওপারের বিভিন্ন জেলায় ইতোমধ্যে ছোট-বড় নানা শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, বিমানবন্দর ইত্যাদি প্রকল্পের কথা ভাবছে। পদ্মা সেতুর কাছেই গড়ে উঠছে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি। খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে জাহাজ নির্মাণ শিল্প দ্রুত বিকশিত হবে। ইতোমধ্যে নানা ধরনের এসএমই উদ্যোগ স্থাপনের হিড়িক পড়েছে। পোশাক শিল্প, অ্যাগ্রো প্রসেসিং শিল্প গড়ে তোলার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

ঘ. কৃষিক্ষেত্রে: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি ও অন্যান্য কৃষি সংশ্লিষ্ট মানুষ মানসম্পন্ন কৃষিদ্রব্য চাষ, আহরণ ও উৎপাদনে উৎসাহী হবে। ব্যবসায়ীরা বরিশাল, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে মাছ ও অন্যান্য কৃষিজ পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতে পারবে সহজেই। এছাড়া নড়াইল, যশোর, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরের আম, লিচু, কালোজিরা, ধনে, তিল, তিসি, সরিষা, পিয়াজ, মধু, দই ও ঘিয়ের মতো কৃষিজ সামগ্রীর ন্যায্য দাম পেয়ে উৎপাদনে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে।

৫. দারিদ্র্য বিমোচনে কৃষি ও শিল্পসামগ্রীর ন্যায্যমূল্য পেয়ে পদ্মার ওপারের বিশাল এলাকার দরিদ্র মানুষ তাদের জীবনমান উন্নয়নে তৎপর হয়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ার সুযোগ তৈরি করছে। মাঝারি ও বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়ে এলাকার মানুষ তাদের দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারবে। এভাবেই দারিদ্র্য নিরসনসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ অবদান অব্যাহত রাখবে।

জিডিপি: সার্বিকভাবে পদ্মা সেতু আমাদের জাতীয় জিডিপিতে ১.২৬ শতাংশ প্রতিবছর যোগ করবে। আঞ্চলিক জিডিপিতে যোগ হবে ৩.৫ শতাংশ। পদ্মা সেতুতে রেল চালু হলে জাতীয় জিডিপিতে যোগ হবে আরও ১ শতাংশ। প্রতিবছর দক্ষিণ বাংলায় দারিদ্র্য কমবে ১.০৪ শতাংশের মতো। জাতীয় পর্যায়ে তা কমবে ০.৮৪ শতংশ।

উপসংহার: পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, প্রকৌশল উৎকর্ষ ও সামগ্রিক পারঙ্গমতার প্রতীক এবং জাতি হিসেবে আমাদের নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সোপান। কীর্তিনাশা পদ্মার ওপর নির্মিত এ সেতু বাংলাদেশের এক অভাবনীয় কীর্তি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পথে এটি একটি মাইলফলক। ডিজাইন কমপ্লেক্সিটি, নির্মাণশৈলী ও ভৌত কাজের পরিমাণ বিবেচনায় এ সেতু ইতোমধ্যেই 'পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ী স্থাপনা' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর এটাই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। সচল অর্থনীতির সফল চাবিকাঠি পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে নিজ গৌরবে আরও একবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।